ছোট গল্প
01.12.2016
মেয়েটা বিরক্ত হচ্ছিল কেন আল্লাহ মালুম। উসখুস করছিল। গাড়ির দরজা খুলে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-এই যে মিস্টার এইখানে গাড়লের মত দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছেন কেন?
-তাতে আপনার প্রবলেম কি? আমার মা তো আপনার বয়সী নন!
-ইডিয়ট। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্যক্ত করবে। আর কিছু বললে বলবে, আপনি বলার কে? আপনি কি আমার মা!
-এই যে সিস্টার! আমি কোথায় আপনাকে উত্যক্ত করলাম!
-এই যে অন্ধজন! একজন সুন্দরীর দিকে না তাকানোই তাকে উত্যক্ত করা!
এবার আমি তাকালাম। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে। সাধারণত পূর্ণ দৃষ্টি মেলে কোন মেয়ের দিকে তাকাই না। নিতে পারে না। একবার পান্না আপু বলেছিল, আমার দৃষ্টি ভয়ানক। লাজুকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিষধর কালকেউটে! সুন্দরী এবার কুঁকড়ে গেল! হেমন্তের শীত শীত বিকেলে একটু কেঁপে উঠল হয়তবা। নারী দেখে গাড়ি দেখলাম। পাজেরো। গাড়ির অপর পাশে রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছে ড্রাইভার! আমাদের আলাপ শুনছে। ভেতরে ভেতরে ঘামছে। তার আতঙ্ক দেখে মনে মনে নিজেকে যাচাই করলাম। আমি তো ভয়ানক বলে পরিচিত নই কোনো তল্লাটে! অযথা ভয় পাচ্ছে কেন ছোকরা! তারপরই আচানক কথাটা মনে পড়ল! সুন্দরীর দিকে আবার তাকালাম। একে দেখেছি কোথাও। শীপ্রা নদী তীরে না হোক তেতুলিয়ার ঘাটে!
ডান হাত নাচিয়ে তুড়ি মেরে মেয়েটি বলল, 'আমি চাইলে তোকে এখানে পুতে ফেলতে পারি জানিস?' এবার চমক ভাঙল। আগের কথাগুলো যা শুনেছি তাই ছিল, নাকি অন্য কিছু? মাগো! তুমি কোন শ্মশান থেকে উঠে এসেছো মা! এবারের মত ক্ষমা কর অভাজনকে। মা তো মা নন, যেন সাক্ষাৎ নেমেসিস। মোবাইল কানের কাছে তুলে কোথাও ফোন করল। আমি ততক্ষণে প্রথম কথোপকথনের অডিও মনের মন্দিরে চালিয়ে দিলাম। মেয়েটি বলছে,
-এই যে বান্দরের বাচ্চা এইখানে গাড়লের মত দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিস কেন?
-তাতে আপনার প্রবলেম কি? আপনার বয়সী আমার তো কোন মা নেই!
-ইতরের মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্যক্ত করবি। আর বলবি আপনি আমার মা নাকি!
-এই যে সিস্টার! আমি কোথায় আপনাকে উত্যক্ত করলাম!
- থাপড়িয়ে কান লাল করে দিলে বুঝবি উত্যক্ত করেছিস কিনা!
এই সেরেছে। কী শুনতে কী শুনেছি! ছি ছি ছি! লোকে কী ভাববে আমাকে! মান সম্মান তো কিছুই থাকল না আর! যা দিনকাল পড়েছে! কয়েক টন মান নিয়ে বাসা থেকে বেরুলেও দিন শেষে তার ছিটেফোঁটাও থাকে না। আর মেয়েগুলোও হয়েছে হাড় বজ্জাত! কেন রে, তোদের বাসায় কি বাপ-ভাই নেই? এভাবে গাড়ি থেকে নেমে একজন ভদ্র লোককে কেউ অপমান করে? ইতর কাহিকা!
কয়েকটা তাগড়া জোয়ান এল মটর সাইকেলে চড়ে। এহ্ আসছে পুরুষের শক্তিতে বলীয়ান হইতে। এতই লেডি মাস্তান হইছ, মটর সাইকেলে কইরা লেডি মাস্তান আনতে পার না! সেই পুরুষের কাছেই হাত পাততে হইল! সানগ্লাস কপালে তোলা এক ছোকড়া বলছে, আপা কি হইছে কন? মেয়েটা গাড়িতে উঠতে ইশারা করল আমাকে। বললাম, ‘না না, প্রবলেম নাই। আমি বাসেই যেতে পারব।’ আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা। ‘ব্যাটা ধনুষ্টংকার! তোকে লিফট দিতে চাচ্ছি নাকি আমি!’ ‘না মানে এই সব গাড়িতে উঠলে আমার বমি আসে। কী সব সেন্ট দিয়া রাখে- সহ্য হয় না! আর এসি তো বিষ! মাথা আউলায়া দেয়। আমি হইলাম গ্রাইম্যা ভুত। এই সবে টিকতে পারি না।’
মজা পেল মেয়েটা। বলল, ‘চলেন! সামনের ওই পার্কে একটু বসি। আপনাকে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। দুটো কথা বলি।’ থমকে গেলাম! যা শুনেছি তাই বলেছে তো! নাকি অন্য কিছুকে নিজস্ব সফটওয়্যারের কারণে ভুলভাল শুনছি। আবার চালিয়ে দিলাম, নাহ একই কথা! শালার সফটওয়্যার!
আসলে হয়েছে কি! আমি একটু নার্ভাস কিসিমের মানুষ। কোন খারাপ খবর পড়তে পারি না। খারাপ কথা শুনতে পারি না। তাই অনেক চেষ্টা করে মনের মধ্যে এমন এক সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছি যে, সকল খারাপই আমার কাছে ভাল হয়ে যায়। যেমন পত্রিকার শিরোনাম- ‘আবারো ক্রস ফায়ার। আঠারো জন নিহত।’ অথচ আমি পড়ব- ‘হায় ক্রস ফায়ার! আঠারো পলায়ন।’ অবশ্য ইদানীং সফটওয়্যারটা আগের মত সাপোর্ট দিচ্ছে না। নতুন করে সেট আপ দিতে হবে।
-না আম্মু! অফিসে যেতে হবে। বসটা খুব গাড়ল। একদম দেরি সহ্য করে না। দেরি হলেই মাইনে কেটে নেয়। গালমন্দও করে।
-এই তুই আসবি? চোখে মুখে কী ভয়ানক ভংগী! নাহ মেয়েগুলাও আজকাল যা হয়েছে না! কোন কথাই শোনে না।
-কিন্তু আপু! আমার চাকরিটা!
-এই শালা তোর প্রবলেম কি! একবার আম্মু ডাকছিস, একবার আপু ডাকছিস!
সত্যিই কি তেমন ডেকেছি? হায় খোদা, আমার কী হবে! বউকেও কি তাইলে...
মেয়েটা আমার হাত ধরেছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে পার্কের দিকে। লজ্জায় চিৎকার করতে পারছি না। জগতে কত পুরুষ নির্যাতন হয়! পুরুষরা যদি নারীদের মত লজ্জার মাথা খেয়ে তা বলতে পারত তাহলে আজ পুরুষদের এ অবস্থা হত না। হঠাৎ মনে হলো, জগতের নির্যাতিত পুরুষদের নব্বই ভাগই মধ্যবিত্ত বলদ। নাহ এখন তত্বীয় জ্ঞান কপচানোর টাইম না। ইজ্জত ফালুদা হবার আগেই এই জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় বের করতে হবে। আবার সফটওয়্যার নিয়ে বিজি হয়ে পড়লাম। মনে মনে নিজেকে কক্সবাজার নিয়ে গেলাম। কী সুন্দর সাগরের ঢেউ। আহা সাগর! এই নারীকে তোমার ঢেউয়ে ভাসিয়ে নাও। কিন্তু একি! এ নারী যে সাগরের চেয়েও শক্তিশালী। সাগরের সকল প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে আমাকে নিয়ে পার্কে বসল।
-জানেন! পার্কে বসলেই আমার বাদাম খেতে ইচ্ছে করে। এমনিতে খাই না। এমনকি বাসেও যখন হকাররা ‘পাঁচ টাকায় এক প্যাকেট, দশ টাকায় তিন প্যাকেট’ বলে গলা ফাটায় তখনও না। পেটে একটু অম্বলের দোষ আছে কিনা! কিন্তু পার্কে এলেই আমার বাদামের তেষ্টা পায়। না খেলে মনে হয়, কতদিন কিছু খাই না। আচ্ছা মা মনি! তোমার বাবার নাম কি?
মেয়েটা আমার পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। মেয়েরা এত ভাল হয় কেন! পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ষণ্ডাকে বলল, যা একটা বাদামওয়ালা নিয়ে আয়। বাজান আমার বাদাম খাইতে চাইছে শুনছস না! আমি আবার পেছনের কথাগুলো চালিয়ে দিলাম-
-এই যে আংকেল কোথায় যাবেন আপনি? চলেন আপনাকে রেখে আসি।
- আমার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। মেয়েটা তোমারই বয়সী মা!
- অনেকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তো আপনার মেয়ের মতই।
- না মা তুমি যাও। আমি বাসেই কমফোর্ট ফিল করি। এসি গাড়িতে গা গুলিয়ে ওঠে।
- আমার বাবাও আপনার মত ছিল। এসি সহ্য হত না।
বাদাম ভাংছি। বাদাম খাচ্ছি। ভেংগে মেয়েটার হাতেও তুলে দিচ্ছি। মেয়েটাও আমার হাতে তুলে দিচ্ছে। আমি গল্প বলছি। হার্মাদ দস্যুর গল্প। ‘ক্যারফার চরে তখন হাতে গোনা আট দশটা ঘর। একদিন হার্মাদ আর মগরা নৌকা ভিড়াইলো আমাগো ঘাটে। একবার যখন চিনছে বার বার আইবো। তাই চিন্তা করলাম এগুলারে মাইরা ফেলতে হইব। মাত্র আটজন লোক নামল নৌকা থেকে। আমি যখন ডুব দিয়া নৌকার কাছে গেছি হঠাৎ কইরা কইত্তেন জানি একটা জিপ গাড়ি আমার সামনে আইয়া পড়ল। আমি লাফ দিয়া ফুটপাথে উইঠা গেলাম।’
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমার গন্তব্যগামী কোন বাস এখনো এলো না। মেয়েটা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। বাদামের খোসাগুলো নাচছে। আমি তালে তালে পা ঠুকছি। চুমকি চলেছে একা পথে........