ছোট গল্প
28.12.2014
একটি বিশ্বমানের চলচ্চিত্র বানাবো। প্রয়োজনীয় আলাপচারিতা সেরেছিলাম ছ'মাস আগের এক সকালে। উপস্থিত ছিল তিনজন অশরীরি, দুটো চড়ুই, সকালের বাতাস এবং গুটিকয় সিনেমানবিস। ভোর হলেই এখন তাই বাতাসের স্নিগ্ধ আঁচল ঘরময় ওড়াওড়ি করে। কিচির মিচির করে ঘরকুনো চড়ুই। সুবাদে ভোরটা এখন প্রাণময়। দিনগুলো সৃজনশীল।
খুব দ্রুত এগোয় সিনেমার কাজ। গল্পটা অসাধারণ। মু্ক্তিযুদ্ধের। মেরে দেয়া নয়। সাম্প্রতিক সময়ের অসম্ভব প্রতিভাধর এক গল্পকার লিখেছেন এটি। বাড়িয়ে বলছি না, আমার দিনরাত পিড়াপিড়িতেই গল্পটি শেষ করতে পেরেছিলেন তিনি। পরিচালকের ক্যারিয়ারটা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দিয়ে শুরু করতে চাই। বরুণ অবশ্য টিটকারি করে বলেছিল, রাজনীতিবিদরা যেমন মাজার জিয়ারত বা ওমরা পালনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দুবৃত্তিপনার যাত্রা শুরু করে, তুইও কি তেমনি সিনেমার নামে অশ্লিল খাদ্য গেলানোর জন্য শুরু করছিস মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে! আমি হেসেছিলাম। এ সব সমালোচনা গায়ে মাখার লোক আমি নই। দীর্ঘদিন থেকে আমার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন একটা ছবি বানাবো যা বদলে দিবে বাংলা চলচ্চিত্রের গতিপথ!
ফিল্ম নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা আমার। দেশে কোর্স করেছি কয়েকটা। অনলাইনে অনেকগুলো মুভি কমিউনিটিতে ভালো চলচ্চিত্র বোদ্ধা হিসেবে আমার ব্যাপক নামডাক। ফ্রান্স থেকে সম্প্রতি চলচ্চিত্র বিষয়ক দুই বছরের একটি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছি। হলিউড ঘুরে এসেছি একবার।দীর্ঘদিনের ইচ্ছা, এমন ছবি বানাবো যা দেখে বিশ্বের তাবৎ পরিচালক ভিমড়ি খেয়ে পড়বে। পুরাতনরা নতুনদের বলবে, এটা দেখে শেখো। মুভি বানালে এমন মুভিই বানাবে।
প্রথমেই বিভিন্ন শ্রেণী এবং পেশার ছয় জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে চুক্তিবদ্ধ হলাম। তারা স্যুটিং এর পুরো সময় আমাদের ইউনিটে থাকবেন।মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবেন। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ, শহীদ জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা, এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গানগুলো সংগ্রহ করলাম। চেষ্টা করলাম পুরো স্যুটিং ইউনিটে মুক্তিযুদ্ধের আবহ তৈরি করতে।
সঠিক সময়ে স্যুটিং শুরু হলো। দ্বিতীয় দিনেই নায়িকা গোল বাধালো। টানা স্যুটিং স্পটে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ সকল আর্টিস্টের সাথে সেভাবেই কন্টাক্ট হয়েছে আমাদের। এখন উপায়? সবদিক ভেবে নায়কের সাথে পরামর্শ করে নায়িকা বদলিয়ে আবার স্যুটিং শুরু করলাম। ততক্ষণে মূল্যবান তিনটা দিন অপচয় হয়ে গেল। তবু ভালো কিছুর আশায় সব ক্ষতি মেনে নিয়ে পুর্ণদ্যমে আবার শুরু করলাম। চারটা লোকেশনে স্যুটিং এর প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে এনেছি। পঞ্চম লোকেশনের প্রথম দিন। সকালবেলা। ছয় মুক্তিযোদ্ধা একত্রে বসে গল্প করছেন। মনে হলো, এঁদের কিছু স্মৃতি রেকর্ড করে রাখি। হয়তো এই ভিডিওটা ইতিহাসের একটি অমূল্য দলিল হয়ে থাকবে। ক্যামেরাটা অন করলাম। কিন্তু একি!
প্রথমত, ক্যামেরাটা ঠিক পরিচিত মনে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এটার ফাংশন কেমন যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি হাবার মত ক্যামেরার চোখ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কথোপকথন দেখি। তারা কখনো হাসছেন। কখনো খুনসুটি করছেন। কেউ চুপ করে থাকছেন তো অন্যরা অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছেন। হঠাৎ ক্যামেরাটা একজনের মুখের ওপর ধীরে ধীরে জুম হলো। মনে হলো ইনি, মানে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলিম কিছুটা ক্লান্ত। ক্যামেরাটা আরো জুম হতে হতে তার কপালের বলি রেখায় লীন হয়ে গেল।
তারপরের ঘটনা ভোজবাজির মত। অকস্মাৎ এবং ভৌতিক। ক্যামেরা থেকে বর্তমান উধাও। সেখানে একটা ভাংগা ঘর আর ছোট পুকুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোবা অতীত। পুকুরের ওপর কতগুলো হাঁসের বাচ্চা ভাসছে। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ। বাচ্চাগুলো নিমিশেই হাওয়া।একটা বড় বোয়াল মাছ লাফ দিয়ে পানি থেকে ডাঙ্গায় উঠে এলো। আবার তড়পাতে তড়পাতে নেমে গেল পুকুরে।কে যেন দৌড়ে ঘরটায় ঢুকলো।তারপর বেরিয়ে এলো ধীরে ধীরে। নিস্তেজ শরীর। বসে পড়লো উঠোনে। ডুকরে উঠলো। আবার দাঁড়ালো। হ্যাঁ লোকটাকে চেনা যাচ্ছে! ক্যামেরা যার দিকে জুম হয়েছিল! তারপর দ্রুত অনেকগুলো দৃশ্য একের পর এক ক্যামেরায় ভাসলো এবং হারালো।কোনোটা মুক্তিযুদ্ধের কোনোটা স্বাধীন বাংলাদেশের। এলোপাথারি, অসংলগ্ন একেকটা দৃশ্য!
একটা পুরানো বাড়ির সামনের দৃশ্যে আটকে গেল ক্যামেরা। এখানে নর্দমা আর ভরপেট ডাস্টবিন উপচে এলোমেলো ময়লার ভাগাড়। দুটো ঘেয়ো কুকুর আর পাঁচটা কুড়ানি ছেলেমেয়ে ময়লা ছানছে।একটা লোক ঘর থেকে বেরিয়ে খক করে কফ ফেললো সিঁড়িতে। ভিক্ষুক ঠেলার দুটো গাড়িতে দুজন ভিক্ষুক নিয়ে বেরিয়ে এলো দুজন। একজন অন্ধ একজন ল্যাংড়াকে আগলাতে আগলাতে বের হচ্ছে। পাঁচটা শিশু আর তিনজন বৃদ্ধ অন্যের কাঁধে সওয়ার। ভিক্ষুকের স্রোতটি বেরিয়ে যেতেই বের হলেন মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আব্দুল আলিম। পানের পিচকারি ফেলে ক্যামেরার চোখ অন্ধ করে দিলেন মুহুর্তে।
ক্যামেরা ঘুরে গেল দ্বিতীয় জনের দিকে।ধীরে ধীরে জুম ইন হচ্ছে। আস্তে আস্তে তার চেহারার গভীরে ঢুকে গেল। তারপর হারিয়ে যেতে যেতে আধা মিনিটের দুরন্ত ছুটে চলা। যেন একের পর এক গাড়ি পাশ কাটাচ্ছে কোন মটর সাইকেল। হঠাৎ সাইকেলটি বাতাসে ডাইভ দিলো। ভেসে থাকলো। তারপর পতন। যেন অনন্তকাল ধরে পড়তেই থাকলো। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যে কোন মুহুর্তে ভেংগে খান খান হতে পারে ক্যামেরাটি।
একটা স্বচ্ছ পানির সুইমিং পুলের পাড়ে গাউন পরে বসে আছেন তিনি। মাননীয় সাংসদ এবং মন্ত্রী। পেপারে বড় বড় অক্ষরে ১৮ খুনের ঘটনা।মন্ত্রীর ঠোঁটে মুচকি হাসি। কজন নিহতের ছবি আছে ভেতরের পাতায়। ছবিগুলোর দিকে মন্ত্রী ধীরে ধীরে ঘৃণার দৃষ্টি হানলেন। দুজন লোক। সশস্ত্র। সম্ভবত পাহারা দিচ্ছে মন্ত্রীকে। একটি বালিকা দৌড়ে এল। তার পিছন পিছন একজন নারী। ফোন এল।সেক্রেটারি কি সব বলে মন্ত্রীকে এগিয়ে দিল। ক্যামেরা ফোনের সিগনাল ফলো করে চলে গেলো অপর প্রান্তে। একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে আছে এক লোক। "ভাই আপনার ঝামেলাটা মিটাই দিলাম। আমাদেরটা যদি একটু দেখতেন"। "হবে হবে সব হবে। তুমি একদিন আমার সাথে দেখা করো।" "জ্বী ভাই আইচ্ছা।" সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
মন্ত্রীর চুল গলে ক্যামেরা মগজে ঢুকে গেল। অনেকগুলো কোষ উপকোষ ঘুরে একটা জায়গায় এসে থামলো। সেখানে বিশেষ একটা স্মৃতি চুপচাপ বসে আছে। তুমুল বৃষ্টি চারিদিকে। কলাপাতা দিয়ে কোন রকমে একটা ছাদ বানিয়ে বসে আছে চারজন সশস্ত্র মানুষ।একটা পিচ্চি দৌড়ে এল। কী যেন ফুসুর ফাসুর হলো। সশস্ত্র ব্যক্তিরা কলাপাতা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এড়িয়ে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। একটা সামরিক জিপ দাঁড়িয়ে সেখানে। পাশের দোকান ঘরে বসে গল্প করছে দুজন মিলিটারি। রেডিওতে বাজছে নুরজাহানের গান। গানের ব্যাকগ্রাউন্ডে নারীকণ্ঠের চিৎকার। আসছে জিপ থেকে। কলাপাতা মুক্তিযোদ্ধারা জিপের দিকে এগিয়ে গেলো। মুহুর্তে পাঁচটা মানুষ লাশ হয়ে পড়ে থাকলো। পিচ্চিটা মা মা বলে কেঁদে উঠলো। আবার জংগলের পথে পা বাড়ালো চারজন মুক্তিযোদ্ধা। সামনের পরিচত মুখ বলে উঠলো, ওর মাকে বাঁচাতে গেলে আমাকে মরতে হতো।
রাওয়ালপিণ্ডির আর্মি হেডকোয়ার্টার। তরুণ বদরুল বসে বসে চিঠি পড়ছে।সবকিছু প্যাক করা। কিছুক্ষণ পরই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবে।দু'মাসের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। চিঠিতে মা লিখেছে, "খন্দকার বাড়ির ফতেমারে সবার পছন্দ হইছে। তুমি আইসা একটু হ কইলেই বিয়াটা হইয়া যাবে।" বদরুলের মা পড়ালেখা জানে না। পাশের গ্রামের চারু মাস্টারকে দিয়ে লিখিয়েছে চিঠি। সারা পথে মা আর ফতেমাকে নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে বদরুল। তারপর বিয়ে, আনন্দ, বেড়ানো, পুকুরে নেমে মাছ ধরা, গাছ থেকে ডাব পাড়া, ফতেমার সাথে একটা গোপন বাজিতে জেতার আশায় পানিতে ডুব দিয়ে দেড় মিনিট পরেই ভুস করে ভেসে ওঠা। শর্ত ছিল দু'মিনিট থাকতে হবে। পারেনি। না না বাজীটা বলা যাবে না। ওটা গোপন বিষয়। বদরুলের পরাজিত মুখের দিকে তাকিয়ে ফতেমার উপচানো আনন্দ মাড়িয়ে বদরুল আবার রাওয়াল পিণ্ডির জন্য গুছগাছ শুরু করে। যাবার আগের রাতে ফতেমা পরাজিত বদরুলকে সেই উপহারটি দিতে চায়।বদরুল ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। "আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। আমি ওটা তোমার সাথে আরেকটা বাজিতে জিতে তবেই নিতে চাই।"
ঢাকায় এসে বদরুল শুনতে পায় বাঙ্গালি যারাই ছুটি থেকে ফিরছে সবাইকে পাকিস্তান নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিচ্ছে পাঞ্জাবিরা! বদরুল সটকে পড়ে। জানে, ধরা পড়লে কোর্টমার্শাল। আর কোর্টমার্শাল মানেই মৃত্যু। পাঞ্জাবীরা কত হারামি জানে সে। ওরা যদি ফতেমার কোনো ক্ষতি করে! তারপর ক্যামেরার চোখজুড়ে অনন্ত শূন্যতা।ক্যামেরাটা যেন মাঝখানের অনেক কিছু মিস করেছে। দীর্ঘ কালো রেখা পার হয়ে একটা বাজারে ভয়ানক গোলাগুলি। বদরুলের ডান কাঁধ ভাসিয়ে রক্ত নামছে। রক্তে ভেসে যেতে যেতে গুলি ছুড়ছে। গোলাগুলি থামাচ্ছে না কোনো পক্ষ। শত্রুরা পেছাতে শুরু করেছে। বদরুল সহযোদ্ধাদের সাথে ক্রলিং করে এগুচ্ছে। রক্ত ঝরতে ঝরতে ক্লান্ত বদরুল। জ্ঞান হারাচ্ছে। হাত শিথিল হয়ে আসে। হঠাৎ গোলাগুলির মাঝখানে জগত সংসারকে তুচ্ছ করে উঠে দাঁড়ায়। শানিতে চিৎকারে চরাচর খান খান করে বলে ওঠে 'জয় বাংলা'। কী থেকে যেন কি হয়ে গেলো। সহযোদ্ধারাও একসাথে বলে উঠলো 'জয় বাংলা'। তারপর সব শান্ত। কোথাও কোনো শত্রু নেই। যেন এক ফালি সবুজ মাঠের উপর দীগন্ত বিস্তারি খোলা আকাশ। ধীরে ধীরে অচেতন বদরুলের দেহটা মাটিতে নেমে আসে।
বাড়ির উঠানে বসে জাল বুনছে বদরুল। শহর থেকে নাতিরা এসেছে। পুকুর থেকে যদি দু-একটা মাছ নাতিদের পাতে দিতে পারে! ফতেমা ঘর থেকে বেরিয়ে বলছে, "সকাল সকাল কী জাল নিয়া পড়লেন। একটু বাজার থেকে ভালো মন্দ মাছ কিনে আনবেন। তা না, পুকুর থেকে তিতকুটি ধরতে হবে। আপনারে নিয়া আর পারা গেলো না।" বদরুল হাসে। নিজের পুকুর থেকে নাতিদের মাছ খাওয়ানোর আনন্দের ব্যাপারে কি কোন ধারণা আছে ফতেমার! নাতীরা যখন শহরে গিয়ে বন্ধুদের বলবে, "জানিস আমার দাদু বাড়িতে ইয়া বড় একটা পুকুর। আর আমার দাদু নিজে সেই পুকুর থেকে মাছ ধরেছে।" তখন গর্বে ওদের মুখটা কত উজ্জল দেখাবে সেটা কি ফতেমা কল্পনা করতে পারবে কখনো!
না না এই বিগড়ানো ক্যামেরা দিয়ে কোনো কাজ হবে না! এভাবে চলে নাকি!বোধহয় ক্যামেরা আমার মনের অবস্থা টের পেয়ে থাকবে। সাথে সাথে চতুর্থজনের দিকে ঘুরে গেলো। আহা বাপ তুমি নিজে নিজে ঘুরলে তো হবে না। আমার কথা অনুযায়ী ঘোরো।আমি যেভাবে তাদেরকে ক্যামেরাবন্দী করতে চাই তুমি তার কী বুঝবা। তুমি কি আমার মত ফিল্মে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছো? নাহ্ আমার কথা শোনার বান্দা নয় এ বজ্জাত ক্যামেরা। সে নিজের হিসাব অনুযায়ী চোখের পাতায় কিছুক্ষণ স্থির থেকে মনির মধ্যে ঢুকে গেল। শরীরের শিরা উপশিরায় দৌড়ালো কিছুক্ষণ। কয়েকটা জায়গায় রক্তচলাচল কম।হার্টের ধুকপুকানি খেয়াল করলো। হার্টটা দুর্বল। শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক স্বাভাবিক নয়।
চোখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল ক্যামেরাটা। ছুটলো।একটা রিক্সার উপর যাত্রী নিয়ে চতুর্থ মুক্তিযোদ্ধা ছুটছে। থেকে থেকে কাশছে। কাশছে এবং প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। যাত্রী হাঁক দেয়, ওই মিয়া যক্ষ্মা বাঁধাইছো নাকি! চিকিৎসা করাইতে পারো না।ফাঁপা গলা দিয়ে মিহি সুরে আওয়াজ বের হয়, "প্যাটই চলে না। চিকিৎসা হইবো কইত্তেন।" চোখ দুটো ঝাপসা হয়। ঝাপসা দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এক যুবক। হাতে বন্দুক। বুকে বারুদ। হৃদয়ে হায়েনা বধের দুর্বার প্রত্যয়। যুবকের সামনে পেছনে আরো যুবক। হাঁটছে। সতর্ক। নি:শব্দ। দূরে শত্রুক্যাম্প। গুড়িয়ে দিতে হবে রাতের আঁধারে। আকাশে অষ্টমির চাঁদ।ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে খাল।খালের কুল ঘেঁসে হাঁটে ভয়হীন শংকাহীন দুর্জয় মানুষ।
হঠাৎ পঞ্চম মুক্তিযোদ্ধা উঠে পড়ে। দু'হাতে ক্রাচ। নকল দুটো পা নতুন, আনকোড়া। আমাদেরই দেয়া। ক'দিন আগেও ভিক্ষা করতো। একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটে যোগ দিলে সেই রকম হবে বিষয়টা। এ কারণেই তাকে ভেড়ানো। নিজেদের দলে আনার আগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করিয়ে নিয়েছি। নকল পায়ে খট খট আওয়াজ তুলে হাঁটে পঞ্চম। এবার শব্দের মধ্যে ঢোকে ক্যামেরার লেন্স। সেখানে ঝড় ঝঞ্ঝা সাইক্লোনের আঁতাত। একে একে শব্দের গোডাউন পার হয়ে একটা পাহাড়ি উপত্যকায় কয়েকটি গোলা-বারুদের শব্দের কাছে থামে রথ।
কোনো মানুষ দেখা যায় না। শুধু থেকে থেকে শোনা যায় গুলির আওয়াজ আর মর্টারের আর্তনাদ।হঠাৎ একটা মানুষ নড়ে ওঠে। দ্রুত ক'পা গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।আস্তে আস্তে অনেকগুলো গোপন মানুষের নড়চড়া ধরা পড়ে।এগিয়ে যাচ্ছে পাক বাহিনী।তিন দিক ঘেরা উপত্যকায় ওরা কারা তবে! মুক্তিবাহিনী? আমরা আকাশে উড়াল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়াই। সে ছায়ায় ঘন জংগল আর পাহাড়ের বাধা ডিঙিয়ে ওপারের পাহাড়ি ঢলে সাঁতার কাটে মুক্তির দল।পেছনে পড়ে থাকে তিনটি লাশ। না না লাশ দুটো। আরেকটি আহত। পাঞ্জাবীরা চলে গেলে কার কার হাত আর কাঁধ ঘুরে যেন সে কোন এক হাসপাতালে দু পা কাটিয়ে বেঁচে থাকে।
ক্যামেরা এবার আরো ভৌতিক একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। প্রায় অপ্রাসংগিকভাবে একটা বৃদ্ধাশ্রমের সামনে চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।এখানকার কাউকেই দেখা যাচ্ছে না সেখানে। কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধের পিছু নেয়। বৃদ্ধ একটা চেয়ারে বসে উদাস চোখে আকাশ দেখে। চোখ থেকে ফোটা ফোটা পানি ঝরে। কিছুক্ষণ দোটানায় দুলতে দুলতে ক্যামেরা অত:পর চোখের পানিতে ডুব দেয়। সেখানে ফুটফুটে দুটো বাচ্চা দাদু দাদু বলে ডাকে। দাদু তখন নদী সাঁতরে পার হচ্ছে। আকাশে ভরা পুর্ণিমার চাঁদ। পিঠে তার খাবারের ব্যাগ। গ্রাম থেকে খাবার নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে।
আচমকা ভোর হয়। দাদুর হাতে স্টেনগান। গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। বারোজন মানুষ। বারোটি স্বপ্ন। বারোটি স্বাধীনতা একে একে ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে বৃষ্টির মত গুলি। মানুষের আদিম বর্বরতা। ঝা-তক-তকে রৌদ্রের পিঠে গ্রেনেডের ঝলক। দূরে কোথাও ডানা ঝাপটায় ভীত সন্ত্রস্ত পাখি। একটা কাটা ঘুড়ি হাওয়ায় গোত্তা খেতে খেতে ভেসে যায়। এই দু:সময়ে ঘুড়িরাও তবে আকাশে ওড়ে!
মুক্তিযোদ্ধারা কথা বলছিলেন সিনেমাটি নিয়ে। গল্পটি তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। তাতে অনেক ডাইমেনশন আছে। সাবেক মন্ত্রী বললেন, এমন একটি সিনেমার জন্যই এতদিন ওয়েট করছিলেন তিনি।৬ষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপা আপনি কোন ক্যাম্পে আটক ছিলেন? মুক্তিযোদ্ধা কথা বলে না। গাঢ় দৃষ্টিতে আমার চোখের মধ্যে ঢুকে পড়েন তিনি। ইকবাল হলের রক্তাক্ত করিডোর পার হয়ে কে যেন হেঁটে যায়।থেকে থেকে লাশ টানা দাগ। একটি কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। রহিমের কাছে শুনেছে এই রুমেই ওরা থাকে। রুমটা খোলা। হা করা। ভেতরে রক্তের ছড়াছড়ি।মনপাখিটা গেয়ে ওঠে, তোর রহিমরে বাঘে খাইছে গো রুপবান।অবসন্ন মনে হল থেকে বেরিয়ে আসতেই তিনটি জিপ থামে। সাথে সাথে অফিসারের কড়া উর্দু নির্দেশে রুপবানকে তোলা হয় গাড়িতে।গাড়িতে আঁধার ঘনিয়ে আসে। শরীর মন সব দুলতে থাকে। দিন রাত শুধু দুলুনি।থেকে থেকে কারো ভেজা জিভ তার মুখের ময়লা চাটে। কারো থলথলে দেহ লেপ্টে থাকে শরীরে। কেউ ঘোড়া দাবড়ায়। কেউ গাড়ির হর্ন বাজিয়ে চলে।মাঝে মাঝে শুনশান নিরবতা। নিরবতার মধ্যে কারা যেন কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই কে যেন কার পায়ে পড়ে। "আমার দুইটা মাসুম বাচ্চা, আমারে ছাইড়া দেন। আপনার আল্লার দোহাই লাগে।" আল্লা যেন হঠাৎ করে কান্না বানুর গালে ঠাস করে ওঠে। প্রমত্ত উল্লাসে আল্লা কোথায় ভেসে যায় জানা নেই রুপবানের।এই আল্লার নামে দিনে রাতে পাঁচবার নামাজ পড়তো সে!
সেমি পাকা টিনের ঘরের সামনে রুপবান বসে থাকে।একটা বউ কথা কও পাখি ডাকে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে রহিমের চেহারা। ইচ্ছে ছিল টুকটুকে লাল ঘোমটা পরে রহিমের হাত ধরে অচিন দেশে পাড়ি দিবে। রহিমের লাল রক্ত দেখার পর লালের সাথে তার আঁড়ি।বহুভোগ্যা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ঘরে নিতে রাজী কোন বাঙ্গালী যুবক? ঘর জুটলেও সংসার জোটে না রুপবানের।রুপবানের বুকের ভেতর থেকে থেকে কেবলই রহিম 'বউ কথা কও' হয়ে ডেকে ওঠে।